প্রথমে সরবরাহ করা হয় মোবাইল ফোনে তোলা ছবি। ভারতীয় বিক্রেতাদের নিয়ে আসা অস্ত্র দেখছেন প্রতিবেদক।
|
|
সরেজমিন চোরাচালান - ১ওপারের বাজার থেকে এপারে ব্যাগভর্তি অস্ত্র পারভেজ খান, উত্তরাঞ্চল সীমান্ত এলাকা থেকে ফিরে
চোরাকারবারিদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড আর অভিনব সব কৌশল খুব কাছ থেকে দেখা যেকোনো সাংবাদিকের জন্য দুর্লভ অভিজ্ঞতা। উত্তরাঞ্চল সীমান্তের এপার-ওপার ঘুরে চোরাচালানের আদ্যোপান্ত দেখে এসেছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি। দুই দেশের অন্ধকার জগতের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য নিয়ে চার পর্বের সরেজমিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ।
ভারতীয় বিক্রেতার কাছ থেকে একটি ব্যাগ নিয়ে এক যুবক কিছু দূর এগিয়ে গেল। তার পরনে লাল শার্ট ও লুঙ্গি। ৪০-৫০ গজ দূরে গিয়ে সে শার্ট আর লুঙ্গি খুলে ফেলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আগে থেকে পরে থাকা হাফ প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি। এরপর যুবক আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটি আরেকজনের কাছে হাতবদল করল। এই ব্যক্তির পরনে ফুলপ্যান্ট। সে-ও যুবকের মতোই কিছু দূর এগিয়ে পোশাক পাল্টে ব্যাগটা অন্য আরেকজনের হাতে দিল। সে-ও একই কাজ করল। এভাবে পোশাক আর হাতবদল হতে হতে কমপক্ষে আট-দশ কিলোমিটার ঘুরে সেই ব্যাগটি পেঁৗছাল বাংলাদেশি ক্রেতার হাতে। ক্রেতা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে বিক্রেতার কাছাকাছিই। তাহলে কেন এই লুকোচুরি? এত পথ ঘুরে আসা?
কারণ, ব্যাগের ভেতরের পণ্যটা হলো অস্ত্র। এভাবে অতি সুকৌশলে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিকিকিনি হচ্ছে দিনাজপুর জেলার হিলি সীমান্তের ওপারে ভারতীয় গ্রাম হাঁড়িপুকুরে।
এই তথ্য ও কৌশলের কথা জানা গেল বেলাল আহমেদ নামে ভারতীয় এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। বাংলাদেশের পরিবহন মালিক সমিতির নেতা পরিচয় দিয়ে এবং ঢাকার এক সন্ত্রাসীর সূত্র ধরে অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর বেলালের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, একপর্যায়ে হাঁড়িপুকুরে গিয়ে অস্ত্র বিকিকিনির সব দুর্লভ দৃশ্যও সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়। বেলাল প্রথমেই নিয়ে যায় শম্ভু চাচা নামে পরিচিত একজনের বাড়িতে। সেখান থেকে কারো সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে বেলাল। এরপর ত্রিমোহনী পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে বালুরঘাট বাজারে। বাজারের অদূরে তিনতলা বাড়ির নিচে একটি রেডিও-টেলিভিশন মেরামতের দোকান। পাশে একটি চায়ের দোকান। বেলালের সঙ্গে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় সেখানে। হঠাৎ করে বেলাল সেখান থেকে রিকশায় করে একটি খেলার মাঠের পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে পুরনো রংচটা একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। ডান-বাঁয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা তাকে অনুসরণ করতে বলে বেলাল ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। অপ্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ড্রয়িং রুমে খানিকক্ষণ বসতেই হলুদ রঙের পুরনো ব্যানার জাতীয় কাপড়ে পেঁচিয়ে তিনটি অস্ত্র নিয়ে হাজির হলো দুই যুবক ও এক নারী_রিভলভার ও পিস্তল। বেলাল জানালো, রিভলভার ও পিস্তল ১৫ হাজার টাকা করে। আর শটগানের দাম পড়বে ৩০ হাজার টাকা। পিস্তল ও রিভলবার কিনলে কমপক্ষে ১০টি কিনতে হবে। এর কম হলে দাম পড়বে কিছু বেশি। বেশি দামি অস্ত্রও মিলবে। তিন-সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। ঘড়ি ধরা তিন মিনিট। অস্ত্র বহনকারীরা চলে গেল। আধঘণ্টার মধ্যে আমরাও ফিরে এলাম।
বেলাল জানাল, কারো বাড়িতে অস্ত্র বেচাকেনা হয় না। দেখে, দামে বনলে পরে কৌশলে (যে কৌশলের কথা প্রথমেই বলা হলো) পেঁৗছে দেওয়া হয় বহনকারীর মাধ্যমে। এটি ছাড়াও আরো অনেক কৌশল আছে। এসব কাজে অনেক রকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই অস্ত্র ক্রেতার হাতে পেঁৗছানোর সময়সূচি ঠিক রাখা হয় না। দিন-তারিখেও হেরফের করা হয়। আগেই দাম পরিশোধ করতে হয় হুন্ডির মাধ্যমে। তা ছাড়া প্রথম বহনকারী বাদে বাকি কেউ অস্ত্র বিক্রেতাকে চেনে না। এমনকি ব্যাগ বা প্যাকেটের ভেতরে কী আছে, সেটাও অনেক সময় বহনকারীরা জানে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বলা হয়, ভেতর চোরাচালানের পণ্য আছে। কারণ, লাইনম্যান আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরা অস্ত্রের চালান সহজে ছাড়তে চায় না। চাইলেও এত বেশি টাকা দাবি করে যে কোনো লাভই থাকে না।
জানা গেল, বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা ও ফরিদপুর এলাকায় অস্ত্রের ক্রেতা বেশি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীরাও তাদের কাছ থেকে নিয়মিত অস্ত্র কিনছে বলে বেলাল জানায়। এই সীমান্ত থেকে প্রতিদিন গড়ে কম করে হলেও ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা হয়। এমনকি বাংলাদেশের পুলিশ ও র্যাবও লোক পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে নিয়ে যায় বলে বেলাল দাবি করে।
অস্ত্র বিকিকিনির এই জমজমাট হাট হাঁড়িপুকুর হিলির ওপারেই ভারতের বালুরঘাট এলাকার একটি অংশ। দিনাজপুরের হাকিমপুর থানা এলাকার নওপাড়া, রায়ভাগ, নন্দীপুর আর মংলা ঘাসুদিয়া দিয়ে অবাধে যাতায়াত করা যায় হাঁড়িপুকুরে। প্রবেশ পথে বিডিআর জওয়ানরা দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো রকম বাধা দেয় না। জিজ্ঞাসাও করে না কিছু। রেললাইন পার হয়ে সোজা হাঁটা শুরু করে শুধু ওদের হাতে ২০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলতে হবে, 'ওপারে যাচ্ছি ডাইল খেতে।' ব্যাস, পাসপোর্ট ছাড়াই মিলে যাবে ভিসা।
হাঁড়িপুকুর মসজিদ ঘাটে বা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কিংবা গলির মাথার মুদি দোকানটিতে বসে বাংলাদেশের দিকে তাকালেই দেখা যায়, থেকে থেকে, দলে দলে আসছে মানুষ। কোনো দলে চারজন। কোনো দলে সাত থেকে আটজন। অনেকে ওপারে বিডিআরের পাহারায় মোটরসাইকেল রেখে চলে আসছে এপারে। এপার থেকেও একই ভাবে যাচ্ছে ওপারে। কে বাংলাদেশি আর কে ভারতীয়, বোঝার কোনো উপায় নেই।
অস্ত্র ব্যবসায়ী বেলালের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিটি অস্ত্র বিক্রি করে তার লাভ থাকে তিন থেকে চার হাজার টাকা। জার্মান রিভলভার ও পিস্তল বলা হলেও মূলত এগুলো ভারতীয় এবং বেশ উন্নতমানের। সচরাচর ছিনতাইকারীদের কাছ থেকেই বিক্রেতারা আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। অস্ত্র রাখার অর্ধশতাধিক বাড়ি আছে হাঁড়িপুকুর এলাকায়।
হাঁড়িপুকুরে ঢুকলেই প্রথমে মনে হবে গ্রাম এলাকার ছোট কোনো বাজারে ঢুকছি। অধিকাংশ ঘরবাড়ি মাটির। প্রতিটা ঘরে-বারান্দায় দোকান। বারান্দায় ভারতীয় থ্রি-পিস, শাড়ি আর প্রসাধনের পসরা। আর ঘরগুলো ব্যবহার হচ্ছে 'মিনি বার' হিসেবে। হাঁড়িপুকুরে এ ধরনের বার আছে ৩৫টির মতো। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল অবাধে মদ আর ফেনসিডিল খাওয়ার দৃশ্য। গাঁজা আর হেরোইনও চলছে। বিএসএফের সদস্যরাও এসে দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তবে বিডিআর জওয়ানরা ভারতের সীমানায় ঢুকছে না। এসব ঘরেরই বেশ কয়েকটিতে আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা হয়। তবে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে। যে কোনো খদ্দেরের কাছে তারা যে কোনো পণ্য বিক্রি করবে। কিন্তু চেনা খদ্দের ছাড়া অস্ত্র বেচাকেনা নিয়ে কোনো আলোচনাই করবে না। সাফ জানিয়ে দেবে, এখানে এসব চলে না।
স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্র মতে, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্ত এলাকার কোরিয়া, হাটখোলা, চেচড়া, আটাপাড়া, বাগজানা স্টেশন, সদর থানার, জয়পুরহাট সদরের আমদই, পাগলা দেওয়ান, ধলাহার, চকবরকত, রতনপুর ও শালপাড়া এবং দিনাজপুরের হিলির আটাপাড়া, স্টেশন, ফকিরপাড়া, চুরিপট্টি, ফুটবল মাঠ, ডাববাগান ও বালুর মাঠ এলাকায় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একাধিক চক্র আছে। পাশের জয়পুরহাটের ধামইরহাটে রয়েছে আলিম ও ডালিম নামে দুই সন্ত্রাসীর পৃথক চক্র। হিলি স্টেশন এলাকায় অস্ত্র বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত কামাল, জামাল, হযরত, শাহিন ও টগর মলি্লক। এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্র মতে, হিলি স্টেশন পট্টির কামাল হোসেন, রায়হান, মুহাড়াপাড়ার মাহে আলম, মাঠপাড়ার জাহাঙ্গীর আলম (বর্তমানে অস্ত্র মামলায় জেলহাজতে), ভারতের হাঁড়িপুকুরের আতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, নাজির উদ্দীন, শাহাবুল ও বেলাল এই অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে পুরো জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি ও হিলি এলাকার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা আর চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে ১০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একটি সংঘবদ্ধ চক্র। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্রের প্রধান হচ্ছে চন্দন। এলাকায় তিনি অপরাধ জগতের গডফাদার হিসেবে পরিচিত। বাকিরা হচ্ছে_ অবসর চৌধুরী, আঙ্গুর, সাবু চেয়ারম্যান, মোস্তাক ওরফে মাদক মোস্তাক, রনী, চিনি ইসলাম, নীলমনি ও বুলেট। নন্দলাল পার্সী বলে আরেকজনের নাম শোনা গেলেও তার ব্যাপারে জোরালো কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে এরা প্রত্যেকেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। অথচ কয়েক বছর আগেও এদের কয়েকজন ছিল পেশাদার ছিনতাইকারী বা ছিঁচকে সন্ত্রাসী।
অভিযুক্ত গডফাদারদের বয়ান : চন্দন কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা। এসব মিথ্যা প্রচারণার কারণে তিনি এখন এলাকায় না থেকে ঢাকায় থাকেন। একটি মহল রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
চন্দন জানান, তিনি ১৯৯৩ সালে নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর পর আর লেখাপড়া করেননি। বড় ভাইয়ের ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তাঁর দাবি, বর্ডার এলাকার লোকজন পুলিশ ও বিডিআরকে ম্যানেজ করে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার। চন্দন বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে ১০-১২টি মামলা ছিল, তা এখন আর নেই। মামলাগুলোও ছিল মিথ্যা। অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় তাঁকে দুইবার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ধরা হয়েছিল।
আরেক অভিযুক্ত গডফাদার মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক একসময় ছিল ছিঁচকে সন্ত্রাসী। এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। মোস্তাক তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলে, 'একসময় অসৎ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে এখন ছেড়ে দিয়েছি। বরং বলতে পারেন, আমি এখন চোরাচালান আর মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমি এসব করি, তাহলে আমি এলাকা ছেড়ে চলে যাব।' লোকজন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার করছে বলে তিনি দাবি করেন।
জয়পুরহাটের চোরাচালান সাম্রাজ্যের যুবরাজ হিসেবে পরিচিত অবসর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র বা মাদক চোরাচালানের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা ঠিক নয়। পাঁচবিবি বা হিলি এলাকায় তাঁর কোনো যাতায়াত নেই। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো ছিল তাও মিথ্যা। তিনি জয়পুরহাট সরকারি কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা বলে জানান। অল্প বয়সে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় তাঁর বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র বলে তাঁর দাবি।
অবসর চৌধুরী আরো বলেন, তাঁর বাবা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। বাবা দুই বছর সাজা খেটে ছাড়া পাওয়ার পর দশ বছর এলাকায় ছিলেন না। কোনো চোরাচালানির সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই বলে অবসর দাবি করেন।
অস্ত্র চোরাচালান চক্রের গডফাদারদের নাম জানতে চাইলে যে নামটি অনেকের মুখ থেকেই বের হয়ে আসে তিনি হচ্ছেন নন্দলাল পার্সী। তবে সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন তিনি। বর্তমানে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, তিনি আগে বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো ছিল তা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। ভবিষ্যতে পৌর মেয়র পদে নির্বাচন করবেন এবং এ কারণেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এসব বাজে কথা রটাচ্ছে।
আরেক অভিযুক্ত গডফাদার চিনি ইসলামও সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোনো দিনই অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে ওপার থেকে এপারে যারা ভারতীয় চিনি নিয়ে আসত, তাঁদের কাছ থেকে তিনি তা কিনতেন। তবে এখন সেটাও ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত এলাকায় মাছের খামার দিয়েছেন।
প্রশাসনের দাবি : বিডিআর ও র্যাবের একাধিক সূত্র জানায়, জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, হিলি ও বিরামপুর সীমান্ত এখন অস্ত্র পাচারের নিরাপদ রুট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অভিনব কৌশল আর পদ্ধতির কাছে তারা অসহায়। সুনির্দিষ্ট আগাম খবর ছাড়া অস্ত্র আটক সম্ভব নয়। এর পরও চলতি বছরে এই সীমান্ত এলাকা থেকে ২০টি বিদেশি অস্ত্র, ১২টি ম্যাগাজিন, ৬২টি গুলিসহ চারজন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।
সূত্র জানায়, অস্ত্র চোরাচালানিরা বিয়ের গাড়ি আর বর-কনে সাজিয়ে সেই গাড়িতে করে অস্ত্র চোরাচালান করে। এই গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলসহ আরো কয়েকটি গাড়ির বহরও থাকে। আবার জীবিত কাউকে লাশ সাজিয়ে কফিনের ভেতরেও অস্ত্র চোরাচালান হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের ঘটনা ধরাও পড়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে টোকেন দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, চোরাচালান রোধের মূল দায়িত্ব বিডিআরের হলেও পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। সীমান্ত এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় বিডিআরের চৌকি কম। আর সীমান্ত অধিবাসীদের সচেতনতার খুবই অভাব। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে গণসচেনতা বাড়ানো ও স্মাগলিং জোন এলাকায় আরো ফাঁড়ি করার চিন্তা-ভাবনা করছে পুলিশ। তবে দুর্গম এলাকায় অভিযান চালানোর মতো প্রয়োজনীয় যানবাহন তাদের নেই বলে তিনি জানান।
র্যাব-৫-এর সিও কর্নেল মঈনুদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, অস্ত্র চোরাচালানিরা মাঝে-মধ্যেই ধরা পড়ছে, অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে। এর সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। তবে আগের তুলনায় এখন কম। আসলে কোনো পণ্যের চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকবেই। সীমান্ত এলাকা অনেক বড়। সেই তুলনায় র্যাবের জনবল কম। আবার বিডিআর সদস্যও প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাদের মধ্যে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতনতা এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
জয়পুরহাট-হিলির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিডিআরের সিও লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বিডিআরের অন্য কোনো কর্মকর্তাও এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
ভারতীয় বিক্রেতার কাছ থেকে একটি ব্যাগ নিয়ে এক যুবক কিছু দূর এগিয়ে গেল। তার পরনে লাল শার্ট ও লুঙ্গি। ৪০-৫০ গজ দূরে গিয়ে সে শার্ট আর লুঙ্গি খুলে ফেলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আগে থেকে পরে থাকা হাফ প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি। এরপর যুবক আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটি আরেকজনের কাছে হাতবদল করল। এই ব্যক্তির পরনে ফুলপ্যান্ট। সে-ও যুবকের মতোই কিছু দূর এগিয়ে পোশাক পাল্টে ব্যাগটা অন্য আরেকজনের হাতে দিল। সে-ও একই কাজ করল। এভাবে পোশাক আর হাতবদল হতে হতে কমপক্ষে আট-দশ কিলোমিটার ঘুরে সেই ব্যাগটি পেঁৗছাল বাংলাদেশি ক্রেতার হাতে। ক্রেতা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে বিক্রেতার কাছাকাছিই। তাহলে কেন এই লুকোচুরি? এত পথ ঘুরে আসা?
কারণ, ব্যাগের ভেতরের পণ্যটা হলো অস্ত্র। এভাবে অতি সুকৌশলে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিকিকিনি হচ্ছে দিনাজপুর জেলার হিলি সীমান্তের ওপারে ভারতীয় গ্রাম হাঁড়িপুকুরে।
এই তথ্য ও কৌশলের কথা জানা গেল বেলাল আহমেদ নামে ভারতীয় এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। বাংলাদেশের পরিবহন মালিক সমিতির নেতা পরিচয় দিয়ে এবং ঢাকার এক সন্ত্রাসীর সূত্র ধরে অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর বেলালের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, একপর্যায়ে হাঁড়িপুকুরে গিয়ে অস্ত্র বিকিকিনির সব দুর্লভ দৃশ্যও সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়। বেলাল প্রথমেই নিয়ে যায় শম্ভু চাচা নামে পরিচিত একজনের বাড়িতে। সেখান থেকে কারো সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে বেলাল। এরপর ত্রিমোহনী পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে বালুরঘাট বাজারে। বাজারের অদূরে তিনতলা বাড়ির নিচে একটি রেডিও-টেলিভিশন মেরামতের দোকান। পাশে একটি চায়ের দোকান। বেলালের সঙ্গে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় সেখানে। হঠাৎ করে বেলাল সেখান থেকে রিকশায় করে একটি খেলার মাঠের পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে পুরনো রংচটা একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। ডান-বাঁয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা তাকে অনুসরণ করতে বলে বেলাল ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। অপ্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ড্রয়িং রুমে খানিকক্ষণ বসতেই হলুদ রঙের পুরনো ব্যানার জাতীয় কাপড়ে পেঁচিয়ে তিনটি অস্ত্র নিয়ে হাজির হলো দুই যুবক ও এক নারী_রিভলভার ও পিস্তল। বেলাল জানালো, রিভলভার ও পিস্তল ১৫ হাজার টাকা করে। আর শটগানের দাম পড়বে ৩০ হাজার টাকা। পিস্তল ও রিভলবার কিনলে কমপক্ষে ১০টি কিনতে হবে। এর কম হলে দাম পড়বে কিছু বেশি। বেশি দামি অস্ত্রও মিলবে। তিন-সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। ঘড়ি ধরা তিন মিনিট। অস্ত্র বহনকারীরা চলে গেল। আধঘণ্টার মধ্যে আমরাও ফিরে এলাম।
বেলাল জানাল, কারো বাড়িতে অস্ত্র বেচাকেনা হয় না। দেখে, দামে বনলে পরে কৌশলে (যে কৌশলের কথা প্রথমেই বলা হলো) পেঁৗছে দেওয়া হয় বহনকারীর মাধ্যমে। এটি ছাড়াও আরো অনেক কৌশল আছে। এসব কাজে অনেক রকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই অস্ত্র ক্রেতার হাতে পেঁৗছানোর সময়সূচি ঠিক রাখা হয় না। দিন-তারিখেও হেরফের করা হয়। আগেই দাম পরিশোধ করতে হয় হুন্ডির মাধ্যমে। তা ছাড়া প্রথম বহনকারী বাদে বাকি কেউ অস্ত্র বিক্রেতাকে চেনে না। এমনকি ব্যাগ বা প্যাকেটের ভেতরে কী আছে, সেটাও অনেক সময় বহনকারীরা জানে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বলা হয়, ভেতর চোরাচালানের পণ্য আছে। কারণ, লাইনম্যান আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরা অস্ত্রের চালান সহজে ছাড়তে চায় না। চাইলেও এত বেশি টাকা দাবি করে যে কোনো লাভই থাকে না।
জানা গেল, বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা ও ফরিদপুর এলাকায় অস্ত্রের ক্রেতা বেশি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীরাও তাদের কাছ থেকে নিয়মিত অস্ত্র কিনছে বলে বেলাল জানায়। এই সীমান্ত থেকে প্রতিদিন গড়ে কম করে হলেও ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা হয়। এমনকি বাংলাদেশের পুলিশ ও র্যাবও লোক পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে নিয়ে যায় বলে বেলাল দাবি করে।
অস্ত্র বিকিকিনির এই জমজমাট হাট হাঁড়িপুকুর হিলির ওপারেই ভারতের বালুরঘাট এলাকার একটি অংশ। দিনাজপুরের হাকিমপুর থানা এলাকার নওপাড়া, রায়ভাগ, নন্দীপুর আর মংলা ঘাসুদিয়া দিয়ে অবাধে যাতায়াত করা যায় হাঁড়িপুকুরে। প্রবেশ পথে বিডিআর জওয়ানরা দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো রকম বাধা দেয় না। জিজ্ঞাসাও করে না কিছু। রেললাইন পার হয়ে সোজা হাঁটা শুরু করে শুধু ওদের হাতে ২০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলতে হবে, 'ওপারে যাচ্ছি ডাইল খেতে।' ব্যাস, পাসপোর্ট ছাড়াই মিলে যাবে ভিসা।
হাঁড়িপুকুর মসজিদ ঘাটে বা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কিংবা গলির মাথার মুদি দোকানটিতে বসে বাংলাদেশের দিকে তাকালেই দেখা যায়, থেকে থেকে, দলে দলে আসছে মানুষ। কোনো দলে চারজন। কোনো দলে সাত থেকে আটজন। অনেকে ওপারে বিডিআরের পাহারায় মোটরসাইকেল রেখে চলে আসছে এপারে। এপার থেকেও একই ভাবে যাচ্ছে ওপারে। কে বাংলাদেশি আর কে ভারতীয়, বোঝার কোনো উপায় নেই।
অস্ত্র ব্যবসায়ী বেলালের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিটি অস্ত্র বিক্রি করে তার লাভ থাকে তিন থেকে চার হাজার টাকা। জার্মান রিভলভার ও পিস্তল বলা হলেও মূলত এগুলো ভারতীয় এবং বেশ উন্নতমানের। সচরাচর ছিনতাইকারীদের কাছ থেকেই বিক্রেতারা আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। অস্ত্র রাখার অর্ধশতাধিক বাড়ি আছে হাঁড়িপুকুর এলাকায়।
হাঁড়িপুকুরে ঢুকলেই প্রথমে মনে হবে গ্রাম এলাকার ছোট কোনো বাজারে ঢুকছি। অধিকাংশ ঘরবাড়ি মাটির। প্রতিটা ঘরে-বারান্দায় দোকান। বারান্দায় ভারতীয় থ্রি-পিস, শাড়ি আর প্রসাধনের পসরা। আর ঘরগুলো ব্যবহার হচ্ছে 'মিনি বার' হিসেবে। হাঁড়িপুকুরে এ ধরনের বার আছে ৩৫টির মতো। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল অবাধে মদ আর ফেনসিডিল খাওয়ার দৃশ্য। গাঁজা আর হেরোইনও চলছে। বিএসএফের সদস্যরাও এসে দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তবে বিডিআর জওয়ানরা ভারতের সীমানায় ঢুকছে না। এসব ঘরেরই বেশ কয়েকটিতে আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা হয়। তবে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে। যে কোনো খদ্দেরের কাছে তারা যে কোনো পণ্য বিক্রি করবে। কিন্তু চেনা খদ্দের ছাড়া অস্ত্র বেচাকেনা নিয়ে কোনো আলোচনাই করবে না। সাফ জানিয়ে দেবে, এখানে এসব চলে না।
স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্র মতে, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সীমান্ত এলাকার কোরিয়া, হাটখোলা, চেচড়া, আটাপাড়া, বাগজানা স্টেশন, সদর থানার, জয়পুরহাট সদরের আমদই, পাগলা দেওয়ান, ধলাহার, চকবরকত, রতনপুর ও শালপাড়া এবং দিনাজপুরের হিলির আটাপাড়া, স্টেশন, ফকিরপাড়া, চুরিপট্টি, ফুটবল মাঠ, ডাববাগান ও বালুর মাঠ এলাকায় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একাধিক চক্র আছে। পাশের জয়পুরহাটের ধামইরহাটে রয়েছে আলিম ও ডালিম নামে দুই সন্ত্রাসীর পৃথক চক্র। হিলি স্টেশন এলাকায় অস্ত্র বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত কামাল, জামাল, হযরত, শাহিন ও টগর মলি্লক। এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্র মতে, হিলি স্টেশন পট্টির কামাল হোসেন, রায়হান, মুহাড়াপাড়ার মাহে আলম, মাঠপাড়ার জাহাঙ্গীর আলম (বর্তমানে অস্ত্র মামলায় জেলহাজতে), ভারতের হাঁড়িপুকুরের আতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, নাজির উদ্দীন, শাহাবুল ও বেলাল এই অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে পুরো জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি ও হিলি এলাকার অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনা আর চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে ১০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একটি সংঘবদ্ধ চক্র। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্রের প্রধান হচ্ছে চন্দন। এলাকায় তিনি অপরাধ জগতের গডফাদার হিসেবে পরিচিত। বাকিরা হচ্ছে_ অবসর চৌধুরী, আঙ্গুর, সাবু চেয়ারম্যান, মোস্তাক ওরফে মাদক মোস্তাক, রনী, চিনি ইসলাম, নীলমনি ও বুলেট। নন্দলাল পার্সী বলে আরেকজনের নাম শোনা গেলেও তার ব্যাপারে জোরালো কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে এরা প্রত্যেকেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। অথচ কয়েক বছর আগেও এদের কয়েকজন ছিল পেশাদার ছিনতাইকারী বা ছিঁচকে সন্ত্রাসী।
অভিযুক্ত গডফাদারদের বয়ান : চন্দন কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা। এসব মিথ্যা প্রচারণার কারণে তিনি এখন এলাকায় না থেকে ঢাকায় থাকেন। একটি মহল রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
চন্দন জানান, তিনি ১৯৯৩ সালে নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর পর আর লেখাপড়া করেননি। বড় ভাইয়ের ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তাঁর দাবি, বর্ডার এলাকার লোকজন পুলিশ ও বিডিআরকে ম্যানেজ করে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার। চন্দন বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে ১০-১২টি মামলা ছিল, তা এখন আর নেই। মামলাগুলোও ছিল মিথ্যা। অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় তাঁকে দুইবার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ধরা হয়েছিল।
আরেক অভিযুক্ত গডফাদার মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক একসময় ছিল ছিঁচকে সন্ত্রাসী। এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। মোস্তাক তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলে, 'একসময় অসৎ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে এখন ছেড়ে দিয়েছি। বরং বলতে পারেন, আমি এখন চোরাচালান আর মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমি এসব করি, তাহলে আমি এলাকা ছেড়ে চলে যাব।' লোকজন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার করছে বলে তিনি দাবি করেন।
জয়পুরহাটের চোরাচালান সাম্রাজ্যের যুবরাজ হিসেবে পরিচিত অবসর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র বা মাদক চোরাচালানের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা ঠিক নয়। পাঁচবিবি বা হিলি এলাকায় তাঁর কোনো যাতায়াত নেই। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো ছিল তাও মিথ্যা। তিনি জয়পুরহাট সরকারি কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা বলে জানান। অল্প বয়সে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় তাঁর বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র বলে তাঁর দাবি।
অবসর চৌধুরী আরো বলেন, তাঁর বাবা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। বাবা দুই বছর সাজা খেটে ছাড়া পাওয়ার পর দশ বছর এলাকায় ছিলেন না। কোনো চোরাচালানির সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই বলে অবসর দাবি করেন।
অস্ত্র চোরাচালান চক্রের গডফাদারদের নাম জানতে চাইলে যে নামটি অনেকের মুখ থেকেই বের হয়ে আসে তিনি হচ্ছেন নন্দলাল পার্সী। তবে সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন তিনি। বর্তমানে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, তিনি আগে বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো ছিল তা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। ভবিষ্যতে পৌর মেয়র পদে নির্বাচন করবেন এবং এ কারণেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এসব বাজে কথা রটাচ্ছে।
আরেক অভিযুক্ত গডফাদার চিনি ইসলামও সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোনো দিনই অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে ওপার থেকে এপারে যারা ভারতীয় চিনি নিয়ে আসত, তাঁদের কাছ থেকে তিনি তা কিনতেন। তবে এখন সেটাও ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত এলাকায় মাছের খামার দিয়েছেন।
প্রশাসনের দাবি : বিডিআর ও র্যাবের একাধিক সূত্র জানায়, জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, হিলি ও বিরামপুর সীমান্ত এখন অস্ত্র পাচারের নিরাপদ রুট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অভিনব কৌশল আর পদ্ধতির কাছে তারা অসহায়। সুনির্দিষ্ট আগাম খবর ছাড়া অস্ত্র আটক সম্ভব নয়। এর পরও চলতি বছরে এই সীমান্ত এলাকা থেকে ২০টি বিদেশি অস্ত্র, ১২টি ম্যাগাজিন, ৬২টি গুলিসহ চারজন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।
সূত্র জানায়, অস্ত্র চোরাচালানিরা বিয়ের গাড়ি আর বর-কনে সাজিয়ে সেই গাড়িতে করে অস্ত্র চোরাচালান করে। এই গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলসহ আরো কয়েকটি গাড়ির বহরও থাকে। আবার জীবিত কাউকে লাশ সাজিয়ে কফিনের ভেতরেও অস্ত্র চোরাচালান হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের ঘটনা ধরাও পড়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে টোকেন দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, চোরাচালান রোধের মূল দায়িত্ব বিডিআরের হলেও পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। সীমান্ত এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় বিডিআরের চৌকি কম। আর সীমান্ত অধিবাসীদের সচেতনতার খুবই অভাব। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে গণসচেনতা বাড়ানো ও স্মাগলিং জোন এলাকায় আরো ফাঁড়ি করার চিন্তা-ভাবনা করছে পুলিশ। তবে দুর্গম এলাকায় অভিযান চালানোর মতো প্রয়োজনীয় যানবাহন তাদের নেই বলে তিনি জানান।
র্যাব-৫-এর সিও কর্নেল মঈনুদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, অস্ত্র চোরাচালানিরা মাঝে-মধ্যেই ধরা পড়ছে, অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে। এর সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। তবে আগের তুলনায় এখন কম। আসলে কোনো পণ্যের চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকবেই। সীমান্ত এলাকা অনেক বড়। সেই তুলনায় র্যাবের জনবল কম। আবার বিডিআর সদস্যও প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাদের মধ্যে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতনতা এসেছে বলে তিনি মনে করেন।
জয়পুরহাট-হিলির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিডিআরের সিও লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বিডিআরের অন্য কোনো কর্মকর্তাও এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
No comments:
Post a Comment